একাত্তরে পাকিস্তানিদের ছুঁড়া মর্টারশেলে স্বামীসহ আহত হন নুরজাহান বেগম (৭১)। এই মর্টার শেলের আঘাতেই নিহত হন নুরজাহানের বাবা-মা ও ভাই-বোন।
মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হলেও কোনোরকমে বেঁচে যান নুরজাহান। তবে ৫০ বছর পর এসে সেই যন্ত্রণা আবার ভোগাচ্ছে নুরজ্হানকে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন নুরজাহানের মাথায় এখনো রয়ে গেছে একাত্তরের মর্টারশেলের স্প্রিন্টার। ৫০ বছর ধরে মাথায় বয়ে বেরানো স্প্রিন্টারের কারণে স্মৃতি ও বাকশক্তি হারাতে বসেছেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার এই নারী।
নূরজাহান বেগমের স্বামী নুরু মিয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৬ সাল থেকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার টিলাগাঁও ইউনিয়নের লংলা খাস বস্তি এলাকায় বাসিন্দা। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন তারা আখাউড়ার আমোদাবাদের বাসিন্দা ছিলেন।
সম্প্রতি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
নূরজাহানের ছেলে মো. মোবারক হোসেন ও জালাল হোসেন জানান, ১৯৭০ সালে তাদের বাড়ি ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার উত্তরী ইউনিয়নের আমোদাবাদ গ্রামে। সেখানে থাকাকালীন সময়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তাদের বাবা নুরু মিয়া।
মোবারক ও জালালের ভাষ্যমতে, এপ্রিল মাসের শেষের দিকে এক রাতে নুরু মিয়া একটি অপারেশন শেষ করে কিছু সময়ের জন্য বাড়িতে আসেন। ফিরে যাওয়ার সময় স্বামীকে এগিয়ে দিতে যান নূরজাহান বেগম। সাথে ছিলেন নূরজাহানের বাবা এবং খালা। এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর ছোড়া একটি মর্টারসেলের আঘাতে নুরজাহান ও নুরু মিয়া গুরুতর আহত হন। এ হামলায় নূরজাহানের বাবা আনছার আলী, ছোট ভাই নূর ইসলাম (১২), বোন জাহরো খাতুন (১৬) মারা যান।
পরে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হন নূরজাহান ও নুরু মিয়া।
মোবারক ও জালাল বলেন, দিন বিশেক আগে আগে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় থেকে তার স্মৃতি শক্তি ও কথা বলার শক্তি কমতে থাকে। পরে চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেেিডকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি বিভাগ) মনো ও স্নায়ুরোগ চিকিৎসক মো. সাঈদ এনামের কুলাউড়ার চেম্বারে নিয়ে যাই। তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মায়ের মস্তিষ্কে মর্টারসেলের স্প্রিন্টার রয়েছে বলে জানান। পরে উনার পরামর্শে সিলেটে হাসপাতালে চিকিৎসা করাই। এখন উনার দ্রুত উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
নুরজাহানের দুই ছেলে বলেন, জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ স্যার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চেীধুরী স্যার ও ডা. সাঈদ এনাম স্যারের সহযোগিতায় আমার মাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তিনি এখন সেখানে ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। মঙ্গলবার উনার মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে মায়ের চিকিৎসায় সকল সরকারি সুবিধা ও যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান দুই পুত্র।
মোবারক বলেন, ‘আমার মা প্রায় সময় মাথা ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে যেতেন ও খুঁড়িয়ে হাটতেন। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে আমি ও আমার ভাই দেশে আসি। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে মায়ের মাথায় স্প্রিন্টার ধরা পড়ে। অনেক কিছু ভুলে যান। কথাও স্পষ্ট বলতে পারেন না। চলাফেরা বন্ধ।’
চিকিৎসক মো. সাঈদ এনাম বলেন, ‘নূরজাহান বেগমের মুখ থেকে অস্পষ্ট ভাষায় জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধের সময় তিনি ও তার স্বামী পাক বাহীনির ছোড়া মর্টারসেলের আঘাতে গুরুতর আহত হন। পরে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও তার এক হাত ও পা পুরোপুরি সচল হয়নি। উনার মাথায় ব্যাথাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা জেনে আমি এক্সরে করাতে বলি। এক্স-রে রিপোর্টে তার মস্তিষ্কে স্প্রিন্টারের উপস্থিতি দেখতে পাই। পরে সিটি স্ক্যান রিপোর্টে দীর্ঘদিন মাথায় থাকা মর্টারসেলের স্প্রিন্টারের জন্য মস্তিষ্কের তিন ভাগের এক ভাগ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে জানতে পারি।
এই চিকিৎসক বলেন, ‘৫০ বছর ধরে স্প্রিন্টার নিয়ে বেঁচে থাকা বিরল ঘটনা। এরকম বিশ্বে ৫টি ঘটনা পাওয়া গেছে। এখন উনার দ্রুত উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। মেডিকেল বোর্ড গঠন করে উনার মাথার অস্ত্রপাচার করে স্প্রিন্টারটি অপসারণ করতে হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ আমরা ঢাকাস্থ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের অধ্যাপক (নিউরোলজিস্ট ) ডা. জাহেদ হোসেন স্যারের সাথে নূরজাহান বেগমের ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করেছি। বর্তমানে তিনি সেখানে অধ্যাপক (নিউরোলজিস্ট ) ডা. জাহেদ হোসেনের তত্বাবধানে চিকিসাধীন আছেন।’
কুলাউড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান স্যারের পরামর্শে উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ আমি নূরজাহান বেগমের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে অধ্যাপক ডা. জাহেদ হোসেনের সাথে কথা হয়েছে। উনার পরামর্শে নূরজাহানকে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে সোমবার সেখানে পাঠানো হয়েছে। উনার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে সব খবর নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফেরদৌস আকতার ও আমরা একটি প্রতিবেদন তৈরী করবো। সেই প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক স্যারের কাছে পাঠাবো। এরপর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামত নিয়ে যথানিয়মে নূরজাহান বেগমের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. জাহেদ হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, ‘নূরজাহান বেগমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। ৫০ বছর যখন মস্তিষ্কে স্প্রিন্টার নিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়টি জটিল। এখানে তাড়াহুড়ো করা কিছু নেই। উন্নত চিকিৎসার জন্য আমরা একটা মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হবে। বোর্ড যদি সিদ্ধান্ত নেয় অস্ত্রপাচার করে শেলের স্প্রিন্টার অপসারণ করার তাহলে সেটিই করা হবে। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।’